গণ-অভ্যুত্থানে আহত যোদ্ধাদের অতিদ্রুত মন্ত্রী বা উপদেষ্টারা আহত হলে যে মানের চিকিৎসা দেয়া হতো সে মানের চিকিৎসা দেয়ার দাবি জানানো হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের একটি প্রতিনিধিদলকে নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বৈঠকে বসেন ছয়জন উপদেষ্টা। সে বৈঠকে এসব দাবি জানানো হয়। এদিন বিকাল ৪টা ৪০ মিনিটের দিকে বৈঠক শুরু হয়েছে। যদিও বৈঠকটি শুরু হওয়ার কথা ছিল দুপুর ২টায়। জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে ইউনিক আইডি কার্ড দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী দায়িত্ব পাওয়া প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. সায়েদুর রহমান। একইসঙ্গে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রক্রিয়া শেষ করা হবে। এছাড়া আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে লিখিত রূপরেখা দেওয়া হবে। রূপরেখায় দেওয়া টাইমলাইন অনুযায়ী সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। গতকাল সন্ধ্যায় সচিবালয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে আহত ছাত্র-জনতার সঙ্গে ছয় উপদেষ্টার বৈঠক শেষে তিনি এসব কথা বলেন।
এদিকে সভার শুরুতে অনেক বিশৃঙ্খলা হয়েছে। একপক্ষ বিক্ষুব্ধ হয়ে হলরুম ত্যাগ করেন; সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম বারবার চেষ্টা করেও তাদের শান্ত করতে পারছিলেন না। সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দাবিতে সড়ক অবরোধের পরদিন জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আহতরা সচিবালয়ে আলোচনার জন্য গেলেও সেখানে নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ২টার কিছু সময় পর সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান ঢাকার পঙ্গু হাসপাতাল ও চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আহতরা। এর বাইরে অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া আহতরাও চলে আসায় তাতে বাদ সাধেন আগের রাতের বিক্ষুব্ধরা। বিকাল ৪টার দিকে দেখা যায়, একপক্ষ বিক্ষুব্ধ হয়ে হলরুম ত্যাগ করেন। সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম বারবার চেষ্টা করেও তাদের শান্ত করতে পারছিলেন না। হাসনাত তখন বলেন, ‘আহতদের নিয়ে বিভাজনের রাজনীতি আমরা সন্দেহের চোখে দেখি। আপনারা আলোচনা করে দাবিগুলো ঠিক করেন। আমরা আপনাদের চাওয়াগুলো পূরণ করি কি না দেখেন। সব আহতই আমাদের চোখে আহত। এখানে ভেদাভেদ করার সুযোগ নেই।’ আলোচনার কক্ষ ছেড়ে বারান্দায় দাঁড়ানো আহত এক ব্যক্তি বলেন, ‘এখানে এমন লোক দেখতে পাচ্ছি যারা গতকালের আন্দোলনে ছিল না। এখন তারা নিজেদের মধ্যে পাঁচজন প্রতিনিধি ঠিক করে আলোচনা করতে চাচ্ছে।’
গত বুধবার দুপুর থেকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের সামনে শ্যামলী-আগারগাঁও সড়ক অবরোধ করে রাখে কোটা সংস্কার ও আওয়ামী লীগ সরকার পতনের সময় আন্দোলনে আহতরা। তারা সমন্বয়ক থেকে অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়া নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম ও সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদের সাক্ষাৎ না পাওয়া পর্যন্ত অবস্থান চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে দ্বিতীয় দফায় উপস্থিত হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ আন্দোলনকারীদের বলেন, উপদেষ্টা আসিফ ও নাহিদ এই মুহূর্তে ঢাকায় নেই। সবার সঙ্গে বসতে হলে বৃহস্পতিবার (গতকাল) দুপুর ২টার আগে সম্ভব নয়। হাসনাতের আহ্বানে সড়ক ছেড়ে না দিয়ে অবস্থান ধরে রাখেন আন্দোলনকারীরা। রাত ৩টার দিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেখা করতে যান উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ও যুব উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়ে তারা বলেন, আন্দোলনকারী প্রতিনিধির সঙ্গে বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে বৈঠক করা হবে। বৈঠক ও দাবি পূরণের আশ্বাসে গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর ৪টার দিকে আন্দোলনকারীরা সড়ক ছেড়ে দেন পুলিশ জানায়।
এরপর দুপুরে আলোচনার জন্য সচিবালয়ে যান তারা। কিন্তু সেসময় অন্যান্য হাসপাতাল থেকে গণআন্দোলনে আহত আরও অনেকে চলে আসলে ‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টি হয়। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সভাপতিত্বে বৈঠকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, সমাজ কল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ সহকারী মো. সায়েদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। এসময় আহতরা সাত দফা দাবি তুলে ধরেন। তাদের দাবিগুলো হলো- গণ-অভ্যুত্থানে আহত যোদ্ধাদের অতিদ্রুত মন্ত্রী বা উপদেষ্টারা আহত হলে যে মানের চিকিৎসা দেয়া হতো সে মানের চিকিৎসা দিতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানে যারা আহত হয়ে নিজ খরচে চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের চিকিৎসা খরচ পরিশোধ করতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের সম্মাননা কার্ডের মাধ্যমে একটি প্রজন্ম পর্যন্ত মাসিক ভাতা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত যোদ্ধাদের স্মৃতি ফাউন্ডেশন নামে যাদুঘর নির্মাণ করে প্রতি বছর ১ জুলাই হতে ৫ আগস্ট পর্যন্ত শহীদদের স্মরণে গণ-স্বাক্ষর কর্মসূচির আয়োজন করতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন ও আহত হয়ে যারা অঙ্গ হারিয়েছেন, একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে তাদের মেডিকেল ফাইল তদন্ত করে কোনো ডাক্তার বা মেডিকেলের অবহেলার কারণ খুঁজে পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করে সেই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে হবে। আগামীতে রাষ্ট্র সংস্কারে ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহত যোদ্ধাদের মতামত গ্রহণ করতে হবে। প্রসঙ্গত, বুধবার উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দাবিতে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের একাংশ। মাঝরাতেও তাদের বিক্ষোভ অবস্থান অব্যাহত থাকে। পরে রাত আড়াইটার দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের চার উপদেষ্টা সেখানে উপস্থিত হয়ে দাবি মানার এবং আহতদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আজ দুপুরে বৈঠকের আশ্বাস দিলে হাসপাতালে ফিরে যেতে রাজি হন বিক্ষোভকারীরা।